13.8 C
Rajshahi
বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫

Buy now

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

কলেজ ড্রেসটা ঝুলে আছে হ্যাঙ্গারে, কোথাও ওসমান নেই

print news

নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘ওসমান পাটোয়ারী খুবই ভদ্র ও মিষ্টভাষী। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি হওয়ার পর আমার প্রথম পরিচয় তার সঙ্গে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ছিল তার দৃঢ় অবস্থান। সবার উপকারে ছুটে যেত সে। এমন বন্ধুকে হারিয়ে আমরা বাকরুদ্ধ। তাকে ছাড়া পরীক্ষায় বসতে হয়েছে আমাদের। মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। অজানা এক দুঃখ সবসময় তাড়া করছে।’ কথাগুলো শহীদ ওসমান পাটোয়ারীর বন্ধু এরফানের।

লক্ষ্মীপুর থেকে একবুক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে বন্দরনগরীর চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে পড়তে আসা ছেলেটা এখন শান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন। বন্ধুরা কিছুতেই ভুলতে পারছে না তাকে ঘিরে সেই স্মৃতিমাখা দিনগুলো। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া ওসমানের বুক ও শরীর ঝাঁঝরা হয়েছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে।

কয়েক মাস আগে শহীদ হলেও বন্ধুদের স্মৃতিতে ফিরলেন ওসমান, সেই চেনা পরীক্ষার হলেই। সম্প্রতি চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ডিপ্লোমা চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়। ওসমানও ছিলেন কম্পিউটার বিভাগের এই বর্ষেরই শিক্ষার্থী। কিন্তু দেশকে নতুন ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ এনে দিতে প্রাণ দেওয়া ওসমান পাটোয়ারী স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষার হলে থাকতে পারেননি। তবে পরীক্ষার হলে ওসমান আগে যে টেবিলসহ লাগানো চেয়ারটিতে বসতেন সেটিতে বসেননি কেউ। সেই শুন্য চেয়ারের ওপরে শোভা পাচ্ছিল ওসমানের জন্য বন্ধুদের আনা ভালোবাসার ফুলের তোড়া।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বন্ধুরা তুলে ধরেছেন শহীদ ওসমানের স্মৃতি। তাদের একজন লেখেন, ‘ওসমান, কখনো ভাবিনি তোকে ছাড়া পরীক্ষা দিতে যাবো। ডিপ্লোমা লাইফের শুরু থেকেই আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে ক্যাম্পাসে যেতাম। কতই না মজা করতাম। এইগুলা কখনো ভুলবার নয়। আজ সবই আছে শুধু তুই নেইরে বন্ধু!’

আরেক বন্ধু লিখলেন, ‘প্রিয় ওসমান, পলিটেকনিকের ভর্তি হওয়ার ফার্স্ট সেমিস্টার থেকে তোর সঙ্গে ৩০৬ নম্বর কক্ষে মিডটার্ম পরীক্ষা দিয়ে আসছি। আজ ৪র্থ পর্বের মিডটার্ম পরীক্ষা দিলাম সেই ৩০৬ নম্বর কক্ষে। তোর সিটও একই জায়গায় ছিল। কিন্তু ভাই শুধু ছিলি না তুই।’

একসঙ্গে ক্লাসরুম শেয়ার, শহরের এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি-সাজিদ ইমতিয়াজের মনের উঠানে ওসমানের সঙ্গে কাটানো সেই সব স্মৃতি যেন এখনও খেলা করছে।

তার বন্ধু সাজিদ দুঃখ করে বলেন, ‘ওসমান ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হলে সে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে ঘরে বসে থাকেনি, আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল সেখানকার বন্ধুদের সঙ্গে। গত ৪ আগস্ট বিকেলে লক্ষ্মীপুর শহরে গুলিতে সে শহীদ হয়। দেশের জন্য বন্ধুর এই আত্মত্যাগের স্মৃতিকে আজীবন ধরে রাখতে চাই আমরা।’

ওসমানের বড় ভাই মো. ওমর ফারুক কদিন আগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আহ্বানে ঘুরে গেছেন ছোট ভাইয়ের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটউট।

তারই স্মৃতি ফেসবুকে তুলে ধরেছেন তিনি। লেখেন, ‘দেখে এসেছি প্রিয় ওসমানের হেঁটে চলা রাস্তাগুলো, ক্লাসরুম, শিক্ষাঙ্গণ, পড়ার টেবিল, থাকার স্থান। ওসমানকে ছাড়া সবই আছে। কলেজ ড্রেসটা যেভাবে হাতা গুটিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই ঝুলে ছিল। ওসমান ছাড়া সব যেন থমকে আছে, হাহাকার করছে। প্রিয় চট্টগ্রাম তুমি থাকবে হৃদয়ে, ভাইয়ের স্মৃতি যে রেখে এসেছি তোমার বুকে।’

ওসমানের সেই স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এখন তারই বন্ধুদের কাঁধে। বন্ধুবিয়োগে শোকের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া বন্ধুরাও অবশ্য ওই স্মৃতি আঁকড়েই বাঁচতে চান, প্রতিদিন, এমনকি আজীবন!

শহিদ ওসমান পাটোয়ারীর বাবা মো. আব্দুর রহমান(৫০) বলেন, ‘ছেলেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি করিয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ ছেলেও আমাদের ইচ্ছে পূরণে কঠোর পরিশ্রম করতো। কিন্তু ঘাতক বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের স্বপ্ন। ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার আমরা দেখে যেতে চাই। আর কোন ইচ্ছে আমাদের নেই।’

২০০২ সালের ১৯ এপ্রিল জন্ম নেওয়া ওসমান পাটোয়ারীর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর থানার দক্ষিণ রায়পুর গ্রামে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ওসমান পাটোয়ারী। বাবা ব্যবসায়ী ও মা শিক্ষিকা।

মা রেহানা আখতার(৪৮) বলেন, ছোট বেলা থেকেই ছেলের সব ইচ্ছে পূরণ করেছি। ইচ্ছে পোষণ করেছে আন্দোলনে যাবে। আন্দোলনে যাওয়ার আগেও আমার থেকে অনুমতি চেয়েছে। আমি দিয়েছি। ছেলে শহীদ হয়েছে। এতে আমার কোন দুঃখ নেই। সারাদেশের মানুষ এখন আমাকে শহীদের মা হিসেবে চেনে। এটাই আমার কাছে গর্বের ও মর্যাদার।

সম্পর্কিত সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ